রীতা রায় মিঠু, যুক্তরাষ্ট্র থেকে : অনেক দিন পর আজ দুপুরে খাওয়ার জন্য উত্তমকে ম্যাকডোনাল্ডসে পাঠিয়ে ২$ দামের চিকেন বার্গার আর আলুভাজা কিনিয়ে আনলাম। বোনাস হিসেবে উত্তম চিকেন নাগেটসও এনেছে।
আমেরিকায় আসার পর ঘরের বাইরে খাওয়া বলতে আমাদের কাছে ম্যাকডোনাল্ডের ১$ দামের চিকেন বার্গার আর ছোটো এক প্যাকেট আলু ভাজা ছিলো রাজভোগ খাওয়ার মতো ব্যাপার!
মৌটুসি মিশাকে নিয়ে স্টেট লেভেল সোশাল স্টাডিজ ফেয়ার, সায়েন্স ফেয়ার, প্রবন্ধ প্রতিযোগিতা, বক্তৃতা প্রতিযোগিতা এটেন্ড করতে দূরে কোথাও যেতাম, পথিমধ্যে খুব মজা করে ডলার মেন্যু ম্যাগডোনাল্ডস চিকেন বার্গার আর আলু ভাজা খেতাম।
মৌটুসি মিশার ফার্স্ট প্রাইজ ট্রফি পাওয়া উপলক্ষে বাড়ি ফেরার পথে ম্যাক চিকেনের সাথে বোনাস থাকতো চিকেন নাগেট আর অ্যাপেল পাই!
আমরা তখনও সুযোগ পেলেই বেড়াতাম। আমি তো এমনিতেই খুব হিসেবী ছিলাম, আমার মিশা কন্যা ছিলো আমার সহকারী।
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টে খাবার ব ছোটো বেলা থেকেই মিশা দক্ষ ছিলো।
দুই দিনের ছুটিতে কোথাও বেড়াতে গেলাম, বাজেট নির্ভর সস্তার হোটেলে ডাবল বেড একটা রুম নিয়ে আমার ভাইসহ ছয় জন থাকতাম।
আমার ভাই আর আমার উত্তম ঘুমাতো এক বেডে, আমরা মা আর তিন কন্যা ঘুমাতাম আরেক বেডে।
মৌটুসি আর ছোট্টো মিথীলাকে টান টান করে শোয়ার ব্যবস্থা করে আমি মিথীলার পাশে শরীরটা বাঁকা করে শুয়ে দিব্যি ঘুম দিতাম, আর মিশা আমাদের পায়ের নীচে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে ঘুম দিতো।
এই যে দুই পয়সার বিনিময়ে সস্তার হোটেলে থাকা, সস্তার ম্যাকডোনাল্ড বার্গার খাওয়া, এক বেডে চারজন গুটিশুটি করে ঘুমানো---এই নিয়ে কারো মনে কোনো ক্ষোভ ছিলো না, কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো না।
আমরা সকলেই খুব খুশি থাকতাম নিজেদের আনন্দ নিয়ে, কৃতজ্ঞ থাকতাম গরীবের ম্যাকডোনাল্ডস আর 'ডেইজ ইন, বাজেট ইন' নামের হোটেল ম্যানেজমেন্টের প্রতি। [ ইন্ডিয়ান মালিক বলেই হয়তো ডাবল বেড রুমে ছয় জন থাকা নিয়ে কখনো আপত্তি করতো না। কারণ তারাও এইভাবেই কষ্ট করেই আমেরিকার মতো দেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে]
২২ বছর পেরিয়ে গেছে আমরা আমেরিকায় আছি। আমাদের তিন কন্যা এখন নিজেদের পয়সায় ইউরোপ আমেরিকা বেড়ায়, নামী দামী হোটেলে থাকে, ১ ডলারের ম্যাক চিকেন খাওয়ার পরিবর্তে ১০০ ডলার খরচ করে হয়তো এক প্লেট অক্টোপাস শামুক ঝিনুক ক্রোকোডাইল ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক রকমের অখাদ্য কুখাদ্য টেস্ট করে দেখে কেমন খেতে!
ছুটিছাটায় যখন আমরা একত্রিত হই, আমরা আমেরিকায় আমাদের প্রথম জীবনের কথা স্মৃতিচারণ করে সুখ অনুভব করি। আমরা এখনও কোথাও বেড়াতে গেলে যে কোনো একবেলা ম্যাকডোনাল্ডসের সামনে গাড়ি থামিয়ে আগের মতো $ মেন্যু দেখে চিকেন বার্গার আর আলুভাজা কিনি।
একই রকম স্বাদ, একই রকম অনুভূতি, একই রকম সুখ অনুভব করি।
রাস্তার পাশে বাজেট ইন, ডেইজ ইন হোটেলের সাইনবোর্ড দেখলেই মা মেয়েরা আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠি, মনে পড়ে যায় এই নামগুলোর সাথে আমাদের কত হৃদ্যতা, কত সুখের স্মৃতি।
এই কথাগুলো লিখার কারণ একটাই, ফেসবুকে অনেকেই আমাকে ভারতের দালাল বলে, কেউ আমাকে চাড্ডি ডাকে[ চাড্ডির মানে আমি জানি না, হয়তো খুব অশ্লীল মানে], কেউ ডাকে বিজেপির চেলা, মোদির বইন, মোদির কন্যা!
শেখ হাসিনার চামচা, শেখ হাসিনা আমার বুবু, এই কথাগুলো বলে আজকাল আর কেউ খোঁটা দেয় না।
হ্যাঁ, ভারত আমার খুব প্রিয়। ভারত আমার কাছে অন্য আর পাঁচ দশটা দেশের মতো নয়। বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি, বাংলাদেশের পরে একমাত্র যে দেশটিকে আমার খুব আপন মনে হয়, সেটা ভারত।
কারণ এই ভারতেই আছে আমার বাবার বাড়ি, মায়ের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ির আত্মীয় স্বজন। কেন ওরা ভারতে, আমি বাংলাদেশে--- তার ইতিহাস অনেক পুরানো। সেসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে বুকে রক্তক্ষরণ করতে চাই না।
এই ভারতেই প্রথম গেছিলাম ১৯৭০ সালে, এক মাস থেকে মায়ের সাথে বেড়িয়েছি চিড়িয়াখানা যাদুঘর গড়ের মাঠ দক্ষিণেশ্বর মন্দির শোভাবাজার, ইলেকট্রিক ট্রেন চড়েছি। আমার বয়স তখন ছয়ের কাছাকাছি। অই শিশু বয়সে দেখা এত সুন্দর সুন্দর স্থান, মনে দাগ কেটে গেছে।
এরপর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী আর্মির চোখ এড়িয়ে আমরা পৌঁছেছি আবারও ভারতেই। রিফিউজি হলেও নয় মাস নিশ্চিন্ত ছিলাম, কাঁকড় মেশানো চালের ভাত খেয়েছি, বাজে আটার রুটি খেয়েছি তবুও খুশি ছিলাম কেউ আমাদের গুলি করে মারতে পারবে না!
শিশু বয়সে প্রাণে বেঁচে থাকার অর্থ বুঝতে না পারলেও গুলি খাওয়ার ভয় নেই, বোমায় মরে যাওয়ার ভয় নেই, বাবা মায়ের চোখেমুখে আতংক নেই-- এর যে কী অনুভূতি এটা বুঝতে পারবে বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া রোহিঙ্গা শিশুরা।
রোহিঙ্গা শিশুদের মনে বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ, ভালোবাসা তৈরি হবে কিনা জানি না, কিন্ত আমার ভেতর সেই ছোটোবেলা থেকেই তৈরি হয়েছে ভারতের প্রতি ভালোবাসা, অন্তরের টান।
ম্যাকডোনাল্ডস আর ডেইজ ইনের সাথে আমার কন্যাদের যে মধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে, যত বড়ো বড়ো হোটেল রেস্টুরেন্টেই ওরা এখন যাক না কেন, ছোটোবেলার ম্যাকডোনাল্ডস আর হোটেল বাজেট ইনের প্রতি কৃতজ্ঞতা থেকে যাবে।
ঠিক ভারতের প্রতি আমার, আমার মতো আরও অনেকের যে কৃতজ্ঞতা বোধ, ভালোবাসার সম্পর্ক আজও রয়ে গেছে, নিমক-হারাম না হলে এই ভালোবাসা কৃতজ্ঞতা বোধ আজীবন থাকবে।
[পুনশ্চঃ জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। ২০ বছর আগের ১$ দামের চিকেন বার্গারের দাম এখন ২.৫০$]